দালালদের ওয়ানস্টপ সার্ভিস চলছে
রাজধানীর মিরপুরে অবস্থিত প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) ও ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়। সোমবার সকাল পৌনে ১১টা। সেখানে আসেন শেরপুরের নালিতাবাড়ী কসলপাড়া ইউনিয়নের প্রাইমারি স্কুলের সহকারী শিক্ষক তোয়েব আলী। ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ে অফিসে আসতেই দালালদের ডাক। কি কাজ আমাদের দেখান। তোয়েব আলীও তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে তার বদলির বিস্তারিত বললেন। তিনি দালালদের বলেন, গত বছর শেরপুর থেকে ময়মনসিংহ বদলির জন্য আবেদন করেছিলাম। আমার স্ত্রী ময়মনসিংহ সদরে একটি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক।
এছাড়াও সন্তানরা পড়াশুনা করে ময়মনসিংহে। গত বছর উপজেলা ও জেলা শিক্ষা অফিসের ফরওয়ার্ডিং থাকার পরও বিভাগীয় কার্যালয় থেকে ছাড়পত্র মিলেনি। টানা তিন মাস চেষ্টা করেও সেই বদলির অর্ডার করাতে পারে নি। তিনি বলেন, এবার আগে বিভাগীয় কার্যালয়ের সিগন্যাল পাওয়ার পর উপজেলা ও জেলায় যাবো। তিনি জানান, গত বছর এই অফিসের একজনের সঙ্গে ১ লাখ টাকা চুক্তি করি।
অগ্রিম ৫০ হাজার টাকাও দেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি ব্যর্থ হন এবং টাকা ফেরত দেন। দালালরা তার সব কথা শোনার পর বলে, আমরা এক জায়গা থেকে সব করে দেবো। আপনাকে উপজেলা ও জেলায় যেতে হবে না। বিনিময়ে টাকা লাগবে দেড় লাখ। অর্ধেক অগ্রিম দিতে হবে। বাকিটা কাজের পর। সব শোনার পর তোয়াব আলী যান বিভাগীয় অফিসে। কিন্তু উপ-পরিচালকের দেখা পাননি। তার অভিযোগ, এর আগেও তার সাক্ষাৎ পায়নি। দালালদের হাতে কাজ দিতে এই অফিস থেকে একটি সিন্ডিকেট তৈরি করা হয়েছে। জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির সময়। এ তিন মাস কোনো শিক্ষকের সঙ্গে সাক্ষাৎ দেন না উপ-পরিচালক। অন্য কর্মকর্তাদের কাছে গেলে বলে, স্যারের সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু স্যারের সাক্ষাৎ আর পাই না।
সুমনা। নরসিংদীর রায়পুরা থেকে নারায়ণগঞ্জ বদলি হওয়ার আবেদন নিয়ে এসেছেন ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ে। স্বামী নারায়ণগঞ্জ ভূমি অফিসে চাকরি করেন।
রায়পুরা ও নরসিংদী জেলা শিক্ষা অফিসের ফরওয়ার্ডিং থাকার পরও প্রায় একমাস ধরে ঘুরাচ্ছে আঞ্চলিক অফিস। সুমনার অভিযোগ, নারায়ণগঞ্জ সদরের যে স্কুলে তিনি যেতে চান সেখানে কোনো পদ ফাঁকা নেই বলে আমাকে বলা হচ্ছে। অথচ পদ ফাঁকা আছে এবং আমার স্বামীর সঙ্গে ওই অফিসের একজন টাকা দিলে বদলি করে দেয়ার কথা বলেছে। তার অভিযোগ, গোপনে আঞ্চলিক অফিসের সঙ্গে এক ধরনের লেনদেন হয় উপজেলা শিক্ষা অফিসের। কেউ বদলির আবেদন করলেই দুই অফিসে একই কথা বলে পদ ফাঁকা নেই। অন্যদিকে আগে থেকে ২ থেকে ৪ লাখ টাকা লেনদেনের মাধ্যমে একেকটি পদে বদলি করা হয়।
শুধু তোয়েব আলী কিংবা সুমনা নয়, বদলির কাজ করাতে এসে এমন হয়রানি বা দালালের খপ্পরে পড়েননি এমন শিক্ষক পাওয়া মুশকিল। যারা প্রভাবশালীদের তদবির নিয়ে আসেন তাদের বিষয় ভিন্ন।
প্রাথমিক শিক্ষার নিয়ন্ত্রক এই দুই অফিসে চারপাশে মৌসুমী দালালদের দৌরাত্ম্য দেখা যায় অহরহ। শিক্ষকদের বদলি করিয়ে দেয়ার নামে দালালরা চালু করছে ‘বদলির ওয়ান স্টপ সার্ভিস’। অন্যান্য বদলি থেকে প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের বদলির প্রক্রিয়া জটিল। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে গত কয়েক বছর ধরে দালালরা প্রকাশ্যে শিক্ষকদের বদলি করানোর নামে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। তবে দালালদের এই অপতৎপরতার বিষয়ে কোনো তথ্য নেই কর্তৃপক্ষের কাছে। তাদের দাবি ডিপিইতে সব কাজ নিয়মমতো হয়। এখানে দালাল প্রবেশের সুযোগ নেই। সরজমিন তথ্য পাওয়ার বিষয়ে জানালে তা খোঁজ নিয়ে দেখার কথা বলা হয় অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রাথমিক শিক্ষা ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের দুই তলায় উপ-পরিচালকের কক্ষ।
কিন্তু জানুয়ারি থেকে মার্চ- এ তিন মাস বদলির সময় তিনি দুই তলার পরিবর্তে অফিস করেন তিন তলায়। সেখানেই ফাইলসহ সব কাজ সারেন। তবে সেই খবর শুধু এখানকার কয়েকজন জানেন। শিক্ষকরা খোঁজ করলেও সোজা জবাব, স্যার অফিসে নেই। কখনও মন্ত্রণালয়, কখনও ডিপিই আর কখনও মিটিং-এ আছেন বলে শিক্ষকদের বিদায় দেন। ভুক্তভোগী শিক্ষকদের অভিযোগ, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই জটিল প্রক্রিয়া। বদলি হওয়ার প্রাথমিক ধাপ হিসেবে একজন শিক্ষককে তার কর্মস্থলের প্রধান শিক্ষক, উপজেলা এবং জেলা শিক্ষা অফিসের ছাড়পত্র নিয়ে বিভাগীয় কার্যালয়ে জমা দিতে হয়। বিভাগীয় কার্যালয় থেকে তার চাহিদামতো জেলা, উপজেলায় তার বদলির জন্য ছাড়পত্র চাওয়া হয়। দুই দিকের ছাড়পত্র পাওয়ার পরই ফাইলের কাজ শুরু হয়। সব ছাড়পত্রের পর বদলি হলেও স্থানীয়ভাবেও বিড়ম্বনায় পড়েন শিক্ষকরা। এসব বিড়ম্বনা ও জটিলতার কারণে অনেক শিক্ষক বদলির প্রথম ধাপেই দালাল বা তদবিরের খোঁজ করেন।
পুরো অভিযোগের ব্যাপারে ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ইন্দু ভূষণ দেব মানবজমিনকে বলেন, দালালদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়ার প্রশ্নই আসে না। অফিসে না থাকার ব্যাপারে তিনি বলেন, এসব অভিযোগ আমার আমলে কেউ প্রমাণ করতে পারবে না। আগের উপ-পরিচালক কি করেছেন সেটি তো আমি বলতে পারবো না। তবে এখন কোনো শিক্ষক এসে আমাকে পায় না এমন নজির নেই। আইনের মধ্যে থাকলে বদলির আবেদন বিবেচনা করা হয় বলেও জানান তিনি।
প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন পর চলতি বছর প্রাথমিক শিক্ষকদের ঢাকায় বদলির নীতিমালা শিথিল করা হয়েছে। উঠিয়ে দেয়া হয়েছে সিটি করপোরেশনে বদলি হওয়া যাবে না এমন কঠিন শর্ত। এরপরই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকাধীন প্রাথমিক স্কুলে দুই শতাধিক শূন্য আসনের বিপরীতে বদলির আবেদন পড়েছে প্রায় ৩৫ হাজার। আবেদনের সঙ্গে রয়েছে এমপি, মন্ত্রীদের ডিও লেটারসহ উপর মহলের তদবির। ফলে কাকে বাদ দিয়ে কাকে ঢাকায় বদলি করবেন তা নিয়ে বিপাকে রয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। সারা দেশে সরকারি প্রাথমিক স্কুলে প্রায় তিন লাখ সহকারী শিক্ষক-শিক্ষিকা রয়েছেন। নানা কারণে অনেকে ঢাকায় পদায়ন চান। এ কারণে তারা উপর মহলের নীতি-নির্ধারকদের ধরে নানাভাবে বদলি তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন।
জানা গেছে, প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষক বদলি সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করে বদলি বিধিমালা সংশোধন করা হয়েছে। সেখানে যোগ্যতা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ও স্বামী বা স্ত্রীর কর্মস্থল ঢাকা হলেই সুবিধামতো স্থানে বদলি হতে পারবেন। বেশির ভাগ বদলির প্রার্থীর আবেদনে বিয়ের কারণে স্বামী-স্ত্রীর কর্মস্থলে বদলি হতে চান। শুধু তাই নয়, বিধবা বা তালাকপ্রাপ্ত বা বড় কোনো দুর্ঘটনার শিকার প্রার্থীরা সুবিধামতো স্থানে বদলি হতে চান।
এ ব্যাপারে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) সোহেল আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, প্রাথমিকে বদলির ব্যাপারে কোনো দালালের কাজ নেই। একজন শিক্ষক নিজ হাতেই সব করার সুযোগ রয়েছে। তারপরও কেউ যদি দালাল ধরেন সেটি তার ব্যাপার। তিনি বলেন, এ অফিসে কোনো দালাল ঢোকার কোনো সুযোগ নেই। তারপরও অভিযোগের বিষয় গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা হবে।
No comments